এখন গ্রীষ্মের ছুটি চলছে। এ সময়ে আমি পড়াই না, তাই সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ক্লাসে যাওয়ার তাগিদ নেই। ছাত্রছাত্রীদের সামনে দাঁড়িয়ে বকবক করার জন্য প্রস্তুতি নিতে হয় না। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি এবং খাতা দেখারও দরকার পড়ে না। তুচ্ছ কারণে শিক্ষার্থীরা ই–মেইল ছুড়ে আমাকে বিরক্ত করে না। কলেজে কমিটি-মিটিং-এরও বালাই নেই। তার মানে এই নয়, আমি গরমের ছুটি এলে অফুরন্ত অবসর সময় পাই। এ না পাওয়ার কারণও আছে। আমি একটি একাডেমিক জার্নাল চালাই। সেই সুবাদে নিত্যদিনই দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে থাকা জার্নালের গ্রাহক, লেখক ও রেফারিদের সঙ্গে আমাকে যোগাযোগ রাখতে হয়। তাঁরাও আমার কাছ থেকে নানা জাতের প্রশ্নের উত্তর চান। যাঁর যাঁর সমস্যা অনুযায়ী সঙ্গে সঙ্গে সমাধান দিতে হয়। জার্নালের আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখতে হয়। শুধু তা–ই নয়, এসব কাজকর্মের সব দলিলপত্র সযত্নে সংরক্ষণ করাও আমার পবিত্র কর্তব্য।
তারপর এদিক-ওদিক যাওয়া তো আছেই। তিন দিনের সফরে বিদেশ গেলে যাওয়া-আসার পথে চলে যায় সাড়ে তিন দিন। যাওয়ার আগে ভিসা, কাগজপত্র, কাপড়চোপড় সব গোছগাছ করতে লাগে এক সপ্তাহ। ফিরে এলে ক্লান্তি দূর হতে হতে চলে যায় আরও দু-তিন দিন। এ সময়টাতে যত কাজ জমা হয় তা গুছিয়ে আনতে আনতে নতুন কাজ থরে থরে জমা হতে থাকে। এসবের বাইরে একটু-আধটু দিনদুনিয়ার খবর রাখারও চেষ্টা করি। লেখালেখি করি। তার ওপর সাংসারিক কাজকর্ম তো আছেই। এত কিছু সামাল দিয়ে বিছানায় যেতে যেতে প্রায় প্রতিদিনই রাত ১২টা-১টা, কোনো দিন আরও দেরি হয়ে যায়। এ নিয়ে গিন্নির সঙ্গে মাঝেমধ্যে খিটিমিটিও হয়।
তারপরও গ্রীষ্মের ছুটিকে আমি ছুটিই মনে করি। এরও একটা ছোট্ট অনুষঙ্গ আছে। যদি বলি, সকালবেলার এক কাপ ‘সোনালি চা’ তাহলে কি অবাক হবেন? চায়ের সঙ্গে ছুটিরও একটা সম্পর্ক আছে। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে আমার মাঝে আমি এক অদ্ভুত বৈপরীত্য লক্ষ করি। একদিকে আমি ষোল আনা একজন ভোজনরসিক। অর্থাৎ মজাদার খাবার আমার খুব প্রিয়। অন্যদিকে যখন যা থাকে তা দিয়েই আমার পেটের খিদে মেটাতেও কোনো অসুবিধা হয় না। কারণ আমার জিবের স্বাদ খুব ধারালো। আমিষ হোক, নিরামিষ হোক, শাক-শুঁটকি, করলাভাজি, আর ডাল-আলু-ভর্তা যা-ই হোক, আমার প্লেটে এলে আমি সেগুলোকে আল্লাহর আশীর্বাদ হিসেবেই দেখি এবং মুখে দিলে অমৃতের স্বাদ পাই। এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহে আমি সৌভাগ্যবান!
ছুটির দিন সকালবেলার নাশতায় ডিম-রুটি-মাখন, জ্যাম-জেলি, ওয়াল, মাফিন, ব্যাল, বিস্কিট, সিরিয়েল, কলা-মুলা যখন যা পাই তা-ই খাই। অনাড়ম্বর পরিবেশে কিচেন টেবিলে বসেই নাশতা পর্বটা সেরে ফেলি। তারপর নিজ হাতে যত্ন করে বড় মগে এক মগ চা বানাই। কিন্তু সেটা রান্নাঘরে বা লিভিং রুমে বসে খাই না। ওপরতলায় নিয়ে আসি আমার নিরিবিলি আস্তানায়–অফিস ঘরে। এখানে একা একা হেলান দিয়ে আরাম করে সোফায় বসে কাচের চওড়া জানালা দিয়ে পাহাড় দেখে দেখে খুব আয়েশের সাথে ধীরে ধীরে খাই। এক কাপ চা খেতে আমার কমসে কম ১৫–২০ মিনিট সময় লাগে। খেতে খেতে চা যাতে ঠান্ডা না হয়ে যায়, সে জন্য গরম চা-কে উত্তপ্ত করে আনি। এই সময়টা এবং চা খাওয়াটা আমি ভীষণভাবে উপভোগ করি। চা খেতে খেতে ভুলেও আমি অন্য কোনো কাজ করি না। এটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত সময়। অবসর সময়। আনন্দের সময়। এ সময়টাকে ভালো করে নিংড়ে নিয়ে আমি তৃপ্তির সঙ্গে উপভোগ করি। বলতে পারেন, এটা আমার একমাত্র নিখুঁত ও নিখাদ বিনোদনের এক মহামাহেন্দ্রক্ষণ।
আশ্চর্য হলেও সত্য এর ১০০ বছর পরও বাংলার গ্রামগঞ্জে অধিকাংশ বাড়িতে চা খাওয়ার কোনো রেওয়াজই তৈরি হয়নি। তার কারণ যতটা না আর্থিক, তার চেয়ে বেশি সাংস্কৃতিক।
চায়ের পেয়ালায় একেকটা চুমুক দেওয়ার সাথে সাথে মনে হয় যেন আমার আয়ু এক মাস করে বেড়ে যাচ্ছে! আরও মনে হয়, আমি যেন জীবন-জগৎ ও সংসার যন্ত্রণা থেকে মুক্ত-স্বাধীন একেবারেই দুশ্চিন্তাহীন একজন মানুষ। তামাম দুনিয়ায় আমার চেয়ে সুখী যেন আর কেউ নেই! আমি যখন নীরবে একাকী চা খাই, তখন নানা ধরনের কাল্পনিক ভাবনা এসে মাথায় ভিড় করে। পেছনে ফেলে আসা দিনগুলো অজস্র রং ধরে একে একে আমার স্মৃতির মিনারে এসে ধাক্কা খায়। রবি ঠাকুরের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে,
‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি…।’
এটুকু লেখার পর অনেক চেষ্টা করেও সেদিন আমি আর এককদমও এগোতে পারলাম না। অগত্যা ফাইলটি সেভ করে বিরতি নিলাম। সপ্তাহখানেক গত হলে আবার কম্পিউটার খুলে লিখতে বসলাম। বাকিটা কীভাবে সাজাব, ভেবে ভেবে কোনো কূলকিনারা পেলাম না। যা লেখা হয়েছে তা-ই বন্ধু মাহবুবের কাছে ইংল্যান্ড পাঠালাম। মাহবুব কিছু সূত্র ধরিয়ে দিল। তার সূত্র এবং আমার স্মৃতিচারণা, এ দুয়ের সংমিশ্রণে সাদামাটা এই মুক্ত গদ্যের বাকি অংশটি তৈরি হলো—ভারতবর্ষে চা চাষের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এটা শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে আজ থেকে প্রায় দুই শ বছর আগে। আঠারো শ ছাব্বিশ সালে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া’ কোম্পানি অহম রাজাদের কাছ থেকে ‘ইয়ান্দাবু’ চুক্তির মাধ্যমে বিশাল পরিমাণ পাহাড়ি জমির দখল নেয়। তারপর চীনা বীজ ও চাষাবাদ পদ্ধতিতে মানুষকে চা-চাষে উৎসাহিত করার জন্য ওই অঞ্চলে বড় বড় উদ্যোক্তাদের দীর্ঘ মেয়াদে জমি বন্দোবস্ত দিতে শুরু করে। শুরুতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাণিজ্যিকভাবে কেউ চা-চাষ করেছিলেন কি না, সে তথ্য আমার জানা নেই, তবে পারিবারিকভাবে নিজের ব্যবহারের নিমিত্তে সবার আগে যিনি চা আবাদ করেন, তার নাম ছিল মণিরাম দেওয়ান। তিনি ১৮০৬ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। সিপাহী বিদ্রোহে জড়িত থাকার কারণে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ১৮৫৮ সালে ফাঁসি দেয়। ‘আসাম টি কোম্পানি’ মুনাফার উদ্দেশ্যে ১৮৩৭ সালে আসাম তথা ভারতবর্ষের প্রথম চা-বাগান আবাদ করে আপার-আসামের ‘চাবুয়া’-তে। চাবুয়া আসামের ডিব্রুগড় থেকে ২০ মাইল পুবে অবস্থিত একটি ছোট্ট শহর। অহমীয়া ভাষায় ‘চাবুয়া’ শব্দটি এসেছে ‘চা’ (মানে চা) এবং ‘বুয়া’ (মানে লাগানো) ইংরেজিতে যার অর্থ দাঁড়ায় – ‘Tea plantation.’। ‘চাবুয়া’ চা-বাগানে প্রথম উৎপাদন শুরু হয় ১৮৪০ সালে। ঠিক একই সময়ে বাংলাদেশে প্রথম চায়ের চারা লাগানো হয়েছিল চট্টগ্রামে–বর্তমানে যেখানে চট্টগ্রাম ক্লাব, সেই জায়গায়। তারপর ১৮৫৪ সালে ‘ডানকান ব্রাদারস’ সিলেট শহরের উত্তর দিকে সালুটিকর এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে ‘মালনী ছড়া’য় ব্যবসায়িকভাবে প্রথম চায়ের চাষ করে। ওই বাগানে প্রথম উৎপাদন হয় ১৮৫৭-তে। একই কোম্পানি ১৮৬০ সালে আরও দুটো বাগিচা চালু করে, হবিগঞ্জের ‘লালচান্দ’-এ এবং মৌলভীবাজারের ‘মেটিঙ্গা’-তে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে দেশীয় বাজারে চা বেচাকেনা শুরু হওয়ার আগে গ্রামগঞ্জের মানুষদের চা-খাওয়া শেখানো এবং তাঁদের মধ্যে চা-কে জনপ্রিয় করে তোলার কাজটি চলতে থাকে। এ লক্ষ্য পূরণে তখন ব্রিটিশ চা-কোম্পানিগুলো হাটের দিন বাজারে বাজারে যেত এবং মানুষদের চা বানিয়ে খাওয়াত। প্রথম প্রথম গ্রামের লোক একেবারেই চা খেতে চাইতেন না। চা কোম্পানির প্রতিনিধিরা অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে বুঝিয়ে-শুনিয়ে চা খাওয়াতে কাউকে কাউকে রাজি করাত। যাঁরা সায় দিতেন তাঁদের বিনা মূল্যে এক কাপ গরম চা দেওয়া হতো এবং এক পুঁটলি চা-পাতা, একটা দেশলাই ও একটা ‘তামার পয়সা বোনাস হিসেবে হাতে ধরিয়ে দিত আজকাল পয়সা তো দূরে থাক, সিকি-আধুলি এমনকি টাকারই কোনো দাম নেই। তাই বলে সে সময়কার ‘তামার পয়সা’-কে অবহেলা করবেন না। ওই সময়ে বাজারে তারও একটা অর্থপূর্ণ ক্রয়ক্ষমতা ছিল। আমার এখনো মনে আছে, ছোটবেলা একটা কানা-পয়সা দিয়ে আমি লেবেনচুষ কিনেছি। এ ছাড়া মোয়া, মুড়ি, বিস্কুট, মার্বেল ইত্যাদিও এক পয়সায় কেনা যেত। আজকাল এক পয়সা ভিখারির কাছেও গ্রহণযোগ্য নয়।
আশ্চর্য হলেও সত্য এর ১০০ বছর পরও বাংলার গ্রামগঞ্জে অধিকাংশ বাড়িতে চা খাওয়ার কোনো রেওয়াজই তৈরি হয়নি। তার কারণ যতটা না আর্থিক, তার চেয়ে বেশি সাংস্কৃতিক। অর্থাৎ তখনো গ্রামের মানুষের মাঝে চায়ের অভ্যাসটা গড়ে ওঠেনি। যাঁরা সচ্ছল এবং সামাজিকভাবে একটু অগ্রসর ছিলেন, শুধু তাঁদের বাড়িতে চায়ের উপায়-উপকরণ থাকত।
আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের সচ্ছলতা এবং অগ্রসরমানতা নিয়ে আমার ঢের সন্দেহ আছে। তথাপি এ কথা ঠিক, আমাদের রান্নাঘরে প্রতিদিন ভোরবেলা সবার আগে চায়ের জন্যই চুলা জ্বালানো হতো। চা বানিয়ে খালি পেটে খাওয়া হতো। কদাচিৎ মুড়ি, টোস্ট কিংবা কুকি বিস্কুট থাকত। খালি পেটে চা খাওয়া যে ভালো নয়, সেটা ওই সময়ে নিশ্চয়ই আমাদের বাপ-দাদারা কেউ জানতেন না। জানলে এমন ধরনের চা-সংস্কৃতি বাড়িতে গড়ে উঠতে পারত না।
উল্লেখ্য, এই চা-পানে বাড়ির সবার সমান অধিকার নিশ্চিত ছিল না। চা পেতেন দাদি, মা-চাচি, বাবা-চাচা, স্কুলের মাস্টার, মসজিদের ইমাম, অতিথি-মুসাফির কেউ থাকলে তাঁরা। বাড়ির কাজের লোক এবং ছোট ছেলেমেয়েরা কেউ চা–য়ে ভাগ বসাতে পারতেন না। কাজের লোকদের মাঝে অবশ্য একজন ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি বংশানুক্রমে আমাদের বাড়িতে থাকতে থাকতে পুরোদস্তুর পরিবারের একজন সদস্যই বনে গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ‘মটর’-এর ছেলে ‘চটর’। আব্বা এবং বড় চাচা ছাড়া তাঁকে কেউ নাম ধরে ডাকতেন না। আমরা ডাকতাম ‘চটর’ চাচা। চা বানানোর পর রান্নাঘর থেকে ‘চটর’ চাচাই যার যার ঘরে চা পৌঁছে দিতেন এবং সবার শেষে মা-চাচিদের সাথে রান্নাঘরে কাঠের পিঁড়িতে বসে তিনিও এক কাপ গরম চা-য়ে মনের সুখে চুমুক বসাতে পারতেন।
আজকাল সচরাচর যেভাবে চা বানানো হয়, অর্থাৎ কেটলিভরা গরম পানিতে এক মুষ্টি ‘টি-ব্যাগ’ চুবিয়ে রেখে অথবা এক কাপ ফুটানো পানিতে এক ব্যাগ চা-পাতা ডুবিয়ে নিয়ে যাঁর যাঁর পছন্দমতো চা বানিয়ে ফেলা, সে যুগে এমনটি ছিল না। শহরে থাকলেও অন্তত গ্রামদেশে টি-ব্যাগ ছিল এক অজানা এবং অপরিচিত বস্তু। আমাদের বাড়িতে তখন গুঁড়ো চা-পাতা থেকেই চা বনানোর নিয়ম ছিল। চুলায় পানি টগবগ করে ফুটে উঠলে পাত্রে নির্দিষ্ট পরিমাণ শুকনা চা-পাতা ঢেলে দেওয়া হতো। বেশ কিছুক্ষণ ফুটানোর পর চায়ের কষ ঘন কালো হয়ে গেলে কাপের মুখে ছাঁকনি ধরে লিকার ঢেলে তারপর আন্দাজমতো দুধ-চিনি মিশিয়ে দিলে মজাদার একেক কাপ ‘সোনালি চা’ তৈরি হয়ে যেত। এখানে ছোট করে একটা কথা বলে রাখি, দুধ-চিনি ছাড়া শুধু হালকা লিকারের রং-চা শরীরের জন্য অনেক বেশি উপকারী। আরেকটি কথা, ‘black tea’ থেকে ‘green tea’ এবং ‘green tea’ থেকে ‘white tea’ আরও বেশি স্বাস্থ্যপ্রদ।
গ্রামের অন্য সব ছেলেমেয়ের সঙ্গে আমিও সকালবেলা ইমাম সাহেবের কাছে আরবি পড়তে আমাদের বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া মসজিদে যেতাম। মসজিদ-ঘরের বারান্দায় বসে আমরা সুরা মুখস্থ করতাম। কায়দা-কোরআন পড়তাম। মাঝখানে ইমাম সাহেব আমাকে প্রতিদিন ছুটি দিতেন তাঁর জন্য বাড়ি থেকে এক কাপ চা নিয়ে আসার প্রয়োজনে। চা নিয়ে ধীরে ধীরে পা ফেলে আসার সময়–বিশেষ করে শীতের দিনে চায়ের কাপ থেকে বাষ্পধোঁয়া যখন কুণ্ডলী পাকিয়ে ওপরের দিকে উঠত, তখন নাকে এসে চায়ের একটা মিষ্টি-মধুর খুশবু লাগত। এতে চা খাওয়ার জন্য আমার ভীষণ লোভ হতো, কিন্তু খেতে পারতাম না। যখন হাইস্কুলে গেলাম, তখনো চা খাওয়ার জন্য আমার ভীষণ লোভ হতো, কিন্তু খেতে পারতাম না। যখন হাইস্কুলে গেলাম, তখনো চা আমাদের জন্য নিষিদ্ধই ছিল। হলে কী হবে, হাতে দু-এক আনা জমলে লুকিয়ে লুকিয়ে বড়লেখা স্টেশনবাজারে বিখ্যাত ‘হবি’-র চায়ের দোকানে বসে মাঝেমধ্যে মিষ্টি চায়ের পেয়ালায় আদরে চুমু খেতাম। কোনো কোনো সময় গরম চা-য়ে শুকনা টোস্ট চুবিয়ে চুবিয়েও খেয়েছি। চা খেতাম ঠিকই, কিন্তু যদি আব্বা দেখে ফেলেন, সেই ভয়ে এত মজার চা খেয়ে সুখ পেলেও আনন্দ পেতাম না। এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার, আমার বাবা শুধু বাড়ির জবরদস্ত মুরব্বিই ছিলেন না, তিনি আমাদের হাইস্কুলের একজন কড়া মাস্টারও ছিলেন।
তার আগে বেশ কয়েক বছর আমি নানাবাড়ি ছিলাম। সেখানে দেখেছি চায়ের সংস্কৃতি একটু অন্য রকম। নানাবাড়িতে সকালবেলা চা খাওয়ার চল ছিল না। এই গরম পানীয়টি বানানো হতো বিকেলে আসরের নামাজের পর এবং এ আয়োজন ছিল প্রতিদিনের নিয়মিত ব্যাপার। জোহরের নামাজ পড়ে ভাত খেয়ে নানা ঘুমাতেন। ঘুম থেকে উঠে আসরের নামাজ পড়লেই চা ও পান-তামাকের জন্য হাঁকডাক শুরু করে দিতেন। তবে বাড়িতে অতিথি এলে দিনদুপুরেও চা করা হতো। এক দিনের কথা আজও আমার মনে পড়ে। নানার মামাবাড়ি একই গ্রামে দীঘির এপার-ওপার। নানার এক মামাতো ভাই ছিলেন সার্কেল অফিসার। একবার তিনি ছুটিতে বাড়ি এসেছেন। কাজে ফিরে যাওয়ার আগে বেড়াতে এসেছেন তাঁর ফুফাতো ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। ওই নানাকে আমরা ডাকতাম, ‘ছানু নানা’। গল্পে রত দুই তুতো ভাইয়ের জন্য আমার ছোট খালা যখন চা বানিয়ে নিয়ে এলেন, তখন ‘ছানু নানা’ তার কাপ ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আরেকটা নিয়ে এসো without sugar’। তখন আমি ইংরেজি শব্দ দুটোর অর্থ বুঝি। আর বুঝি বলেই এক চিন্তায়ও পড়ে গেলাম।
তখন আমার ধারণা ছিল, দুধ-চিনি ছাড়া চা হয়-ই না এবং ওই দিন আমি অনেক ভেবেও বুঝতে পারিনি, নানা চিনি ছাড়া চা চাইলেনই বা কেন। চিনি ছাড়া তিনি চা খাবেনই বা কেমন করে। অনেক পরে জেনেছি আমার ওই আত্মীয় ডায়াবেটিসের রোগী ছিলেন।
চা খাওয়ারও একটা সামাজিক ভদ্রতা আছে। সেটা শিখেছি উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গিয়েছি ঢাকায়। উঠেছি মেজ মামার বাসায়। তিনি বহু বছর লন্ডনে ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সপরিবার ঢাকায় এসে বেশ কয়েক মাস ছিলেন। ওই সময় মেজ মামার বাসায় থাকতেন আমার ছোট মামা এবং বড় ভাইও। ছোট মামা লন্ডন যাবেন এবং বড় ভাই আমেরিকামুখী। এ সময় দুজনের দুই ধরনের প্রস্তুতি চলছে। মামার বাসায় কোনো এক ছুটির দিন সকালবেলা নাশতা শেষে আমরা মামা-ভাগনে চারজন বসে আরাম করে চা খাচ্ছি। ছোট মামা গরম চায়ের কাপে মুখ লাগাচ্ছেন আর সুড়ুৎ সুড়ুৎ আওয়াজ তুলছেন। মেজ মামা একসময় রেগে গিয়ে বললেন, ‘দুদিন পর লন্ডন যাবি অথচ এখনো চা খাওয়া শিখলি না। চা খেতে আওয়াজ করা bad manner.’ ছোট মামা চায়ের সঙ্গে বকা খেলেন, আর আমি নীরবে চা খাওয়ার কায়দাটা শিখে নিলাম।
এবার শুনুন ‘সোনালি চা’-এর গল্প। তখন আমি কানাডার উইনিপেগে পিএইচডির ছাত্র। একবার কোনো এক সেমিনার উপলক্ষে শিকাগোর উইলিস টাওয়ারের (আগে এটা সিয়ারস টাওয়ার নামে পরিচিত ছিল) স্থপতি ফজলুর রহমান খানের ছোট ভাই অধ্যাপক জিল্লুর রহমান খান এসেছিলেন উইনিপেগে। সেমিনার শেষে রাতে তাঁর ডিনারের দাওয়াত ছিল বায়োকেমিস্ট একরামুদ্দৌলা সাহেবের বাড়িতে। সৌভাগ্যক্রমে আমিও সেই পার্টিতে উপস্থিত ছিলাম। রাতের খাবার শেষে গৃহকর্ত্রী যখন অধ্যাপক খানকে বললেন, ‘ভাই, আপনার চা কীভাবে বানাব?’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘ভাবি, বাংলাদেশের ওই এক কাপ ‘সোনালি চা।’ ‘চা’ শুধু এক কাপ চা-ই নয়, ইদানীং চা আমাদের জীবন, সংস্কৃতি ও সামাজিক সম্পর্কের সাথে এমনভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে, যা কিনা অবাক হওয়ার মতো! ভেবে দেখুন, ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘He is not my cup of tea,’ অর্থাৎ ওর সাথে আমার পড়ে না।
সবশেষে বলছি একটি মজার গল্প। গল্প নয়, আসলে এটাও সত্যি ঘটনা। শুনেছি, ঢাকার অনুজপ্রতিম বন্ধু-সংবাদিক হাসান শরীফের কাছে। হাসান বলছেন, পল্লিকবি জসীমউদ্দীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে চা পান করানোর একটি মজার কাহিনি উল্লেখ করেছেন তাঁর ‘ঠাকুর বাড়ির আঙিনায়’ বইতে। কবি নজরুল ছিলেন চা-খোর। কিছুক্ষণ পরপর চা পান না করলে তাঁর চলত না। ফরিদপুরে বঙ্গীয় সাহিত্য সমিতির অধিবেশন উপলক্ষে কবি নজরুল সেখানে গিয়েছিলেন, তবে রাতে কবির সম্মানে জসীমউদ্দীনের উদ্যোগে গানের জলসা বসানো হলো। সেখানেই ওই গল্পের সৃষ্টি। কবি জসীমউদ্দীনের ভাষাতেই কাহিনিটি শোনা যাক, ‘রাত্রিবেলা এক মুস্কিলে পড়া গেল। চা না পাইয়া কবি অস্থির হইয়া উঠিলেন। এই পাড়াগাঁয়ে চা কোথায় পাইব? নদীর ওপারে গিয়া যে চা লইয়া আসিব, তাহারও উপায় নাই। রাত্রিবেলা কে সাহস করিয়া এত বড় পদ্মা নদী পাড়ি দেবে? তখন তিন-চার গ্রামে লোক পাঠানো হইল চায়ের অনুসন্ধানে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আলিম মাতব্বরের বাড়ি হইতে কয়েকটা চায়ের পাতা বাহির হইল। তিনি একবার কলিকাতা গিয়া চা খাওয়া শিখিয়া আসিয়াছিলেন। গ্রামের লোকদের চা খাওয়াইয়া তাজ্জব বানাইয়া দিবার জন্য কলিকাতা হইতে তিনি কিছু চা-পাতা লইয়া আসিয়াছিলেন। গ্রামের লোকদের খাওয়াইয়া চা-পাতা যখন কম হইয়া আসিত, তখন তাহার সহিত কিছু শুকনা ঘাসপাতা মিশাইয়া চায়ের ভান্ডার তিনি অফুরন্ত রাখিতেন। তিনি অতি গর্বের সহিত তাঁহার কলিকাতা-ভ্রমণের আশ্চর্য কাহিনি বলিতে বলিতে সেই চা-পাতা আনিয়া কবিকে উপঢৌকন দিলেন। চা-পাতা দেখিয়া কবির তখন কী আনন্দ!’
‘এই মহামূল্য চা এখন কে জ্বাল দেবে? এ বাড়ির বড় বউ ও বাড়ির ছোট বউ—সবাই মিলিয়া পরামর্শ করিয়া যাহার যত রন্ধনবিদ্যা জানা ছিল সমস্ত উজাড় করিয়া সেই অপূর্ব চা-রন্ধন-পর্ব সমাধা করিল। অবশেষে চা বদনায় ভর্তি হইয়া বৈঠকখানায় আগমন করিল। কবির সঙ্গে আমরাও তাহার কিঞ্চিত প্রসাদ পাইলাম। কবি তো মহাপুরুষ। চা পান করিতে করিতে চা-রাঁধুনীদের অজস্র প্রশংসা করিতেছিলেন। আমরাও কবির সঙ্গে ধুয়া ধরিলাম। গ্রাম্য-চাষির বাড়িতে যত রকমের তরকারি রান্না হইয়া থাকে, সেই চায়ের মধ্যে তাহার সবগুলিরই প্রসাদ মিশ্রিত ছিল। কমিউনিস্ট কর্মী আবদুল হালিম বড় সমালোচনাপ্রবণ। তাঁহার সমালোচনামতে, সেই চা-রামায়ণের রচয়িত্রীরা নাকি লঙ্কাকাণ্ডের ওপর বেশি জোর দিয়াছিলেন। আমাদের মতে, চা-পর্বে সকল ভোজনরসের সবগুলিকেই সমমর্যাদা দেওয়া হইয়াছিল। পরবর্তীকাল বহু গুণীজনের কাছে এই চা খাওয়ার বর্ণনা করিয়া কবি আনন্দ পরিবেশন করিতেন।’