ডায়েট, ব্যায়াম ও ওজন কমানো–বাড়ানো নিয়ে পাঠকদের নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন বারডেম জেনারেল হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান শামছুন্নাহার নাহিদ-
প্রশ্ন: আমার বাবার উচ্চতা ৬ ফুট। আমার মায়ের উচ্চতাও বাবার কাছাকাছি। আমরা তিন ভাইবোন। আমার বড় বোন ও ছোট ভাই দুজনের উচ্চতাই মা-বাবার মতো, শুধু আমি হয়েছি খাটো। আমাদের বাড়ির খাবারদাবারও ভালো। সব ভাইবোনকেই মা-বাবা ঠিকমতো খাবার দিয়েছেন। মাছ, মাংস, সবজি, ফলমূল সবই খেয়েছি। আমার উচ্চতা মাত্র ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। এটা নিয়ে কাছের আত্মীয়স্বজন থেকে বন্ধুবান্ধব, সবাই আমাকে খোঁচা দেয়। কম উচ্চতার কারণে আমার সব সময় মন খারাপ থাকে। আমার বয়স এখন ২১ বছর। কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছি। ওজন ৬০ কেজি। আমার ছোট ভাই এবার এসএসসি পাস করেছে। তার উচ্চতা ৬ ফুট ১ ইঞ্চি, বোনের উচ্চতা ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি। আমরা তিনজনই খেলাধুলা করেছি, সাইকেল চালিয়েছি। তারপরও আমার উচ্চতা কেন এত কম?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ: আপনি বেশ গুছিয়ে লিখেছেন। পাশাপাশি আপনার উচ্চতা কম কেন, তার কারণ জানতে চেয়েছেন। ছেলে বা মেয়েদের উচ্চতা বৃদ্ধি মূলত নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যে হয়ে থাকে, গড়ে যা ১৮ বছর। তবে এখানে মেয়ে ও ছেলেদের বয়সের তারতম্য আছে। এই নির্দিষ্ট বয়সের পর সাধারণত উচ্চতা আর বাড়ে না। বয়স অনুপাতে উচ্চতা বেশি বা কম হওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। প্রধান কয়েকটি কারণ হলো—
বংশগত: ব্যক্তির উচ্চতা অনেকাংশেই নির্ভর করে মা–বাবার উচ্চতার ওপর। যদি পরিবারের অধিকাংশ সদস্য খাটো হন, তবে ওই ব্যক্তিরও খাটো হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যেহেতু আপনার বর্ণনামতে, পরিবারের বাকি সবার উচ্চতা ঠিকঠাক। তাই আপনার ক্ষেত্রে এই কারণ খাটে না।
পুষ্টিহীনতা: উচ্চতা ঠিকমতো না বাড়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, শিশু বা কিশোর বয়সে প্রয়োজনীয় প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, জিঙ্ক, ভিটামিন ডিসহ ক্যালরির ঘাটতি। শরীরের চাহিদা অনুযায়ী ওই খাবার বা পুষ্টি পাওয়া না গেলে হাড়ের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। পাশাপাশি সেই অপুষ্টি যদি বেশি দিনের হয়ে থাকে, তাহলে শরীরে হরমোনের ভারসাম্যও নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়, ফলে উচ্চতা ঠিকমতো বাড়ে না। আপনার লেখায় বলেছেন, আপনারা ঠিকমতো খাবার খেয়ে বড় হয়েছেন। তাই এটাকেও সরাসরি আপনার কম উচ্চতার কারণ বলা যাচ্ছে না।
হরমোনের সমস্যা: শরীরে গ্রোথ হরমোনের ঘাটতি উচ্চতা কম হওয়ার অন্যতম কারণ। থাইরয়েড নামক হরমোনের ঘাটতি শিশুর বৃদ্ধি কমিয়ে দিতে পারে। আপনার এমন কোনো সমস্যা ছিল কি না, জেনে দেখতে পারেন।
দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা: শৈশব-কৈশোরে কারও যদি ঘন ঘন অসুস্থ হওয়ার ইতিহাস থাকে, তাহলে উচ্চতা কম হতে পারে। ছোটবেলায় কারও যদি হৃদ্রোগ, কিডনি রোগ, ক্যানসার, কোলন ডিজিজ বিশেষ করে থ্যালাসেমিয়া ইত্যাদি থাকে, তাহলে উচ্চতা বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। কারণ, এসব অসুস্থতা শরীরের পুষ্টি শোষণে ব্যাঘাত ঘটায়।
জন্মের সময় কম ওজন বা সময়ের আগে জন্ম: সাধারণত অপরিণত অথবা কম ওজনে (২.৫ কেজির কম) জন্মানো শিশুদের পরে যদি সঠিক যত্ন ও পুষ্টি না দেওয়া হয়, তাহলে অনেক সময় তাদের উচ্চতা কম হতে পারে।
হাড়ের রোগ: শিশুদের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কিছু টিকা দেওয়া হয়। কেউ যদি সেটা না পেয়ে থাকে, তাহলে তার বেশ কিছু সংক্রামক রোগ হতে পারে। তার মধ্যে রিকেটস (ভিটামিন ডির অভাবে হয়), কন্ড্রোপ্লাসিয়া ইত্যাদি হলে শিশুর হাড় ঠিকমতো গঠিত হয় না। আর উচ্চতাও কমে যায়।
দ্রুত বয়ঃসন্ধির সূচনা: ছেলে বা মেয়েদের বয়ঃসন্ধি খুব তাড়াতাড়ি শুরু হলে হাড়ের বৃদ্ধির প্লেট (গ্রোথ প্লেট) দ্রুত বন্ধ হয়ে যায়। ফলে উচ্চতা বাড়ার সুযোগ কমে যায়। তাই নিজের বয়ঃসন্ধিকালের বিষয়টিকেও গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। আপনার ক্ষেত্রে তেমন কিছু ঘটেছে কি না, ভেবে দেখুন।
মানসিক চাপ ও পরিবেশগত কারণ: শিশুর বেড়ে ওঠার সময় অতিরিক্ত মানসিক চাপ, দারিদ্র্য, পরিবারিক অবহেলা বা সহিংসতা ইত্যাদি সবকিছুই তার শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে।
ঘুমের ঘাটতি: কৈশোরে যারা রাত জাগে বা শরীরের প্রয়োজনমতো ঘুম নিশ্চিত না করে, তাদের গ্রোথ হরমোনের নিঃসরণ ব্যাহত হয়ে উচ্চতা বৃদ্ধির হার কমে যেতে থাকে।
তাই মা-বাবা লম্বা হলেই যে সন্তান লম্বা হবে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। শুধু বংশগত বৈশিষ্ট্যের কারণে শরীরের উচ্চতা বৃদ্ধি ব্যাহত হয় না, উচ্চতা কম হওয়ার কারণ ব্যক্তিভিত্তিক। এটা নির্ধারণ করার জন্য ব্যক্তির জীবন ইতিহাস, শারীরিক কিছু পরীক্ষা, পুষ্টি ও হরমোন পরীক্ষা করা দরকার। তবে নির্ধারিত বয়সের মধ্যে যদি যথাযথ পুষ্টি, ব্যায়াম ও চিকিৎসা গ্রহণ করা যায়, তবে অনেক ক্ষেত্রে উচ্চতা বৃদ্ধি করা সম্ভব।