বন্ধু, কী খবর বল

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘বন্ধু তোমার পথের সাথিকে চিনে নিও, মনের মাঝেতে চিরদিন তাকে ডেকে নিও, ভুলো না তারে ডেকে নিতে তুমি… গানটি যেন নিজের জীবনের সঙ্গে খুব বেশি মিলে যায়। কারণ এই মহাদুর্যোগে জীবনের টানেই বন্ধুর পাশে থাকা সুখে-দুঃখে, তাকে চিনে নেওয়া বড্ড প্রয়োজন। 

যুগে যুগে শিল্প-সাহিত্যে বন্ধুত্বের জয়গান লেখা হয়েছে। তৈরি হয়েছে নাটক-সিনিমা-গানও। প্রথম বন্ধুত্ব কবে হয়েছিল, কোথায় হয়েছিল, কেন কার সঙ্গে হয়েছিল, কীভাবে হয়েছিল সেটি আবিষ্কার করার চেষ্টা এখন প-শ্রমই বটে। তবে বন্ধু দিবসের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে দেখা যায়, ১৯৩৫ সালে আমেরিকার সরকার এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। দিনটি ছিল আগস্টের প্রথম শনিবার। তার প্রতিবাদে পরের দিন ওই ব্যক্তির বন্ধু আত্মহত্যা করেন। এর পরই জীবনের নানা ক্ষেত্রে বন্ধুদের অবদান আর তাদের প্রতি সম্মান জানানোর লক্ষ্যেই আমেরিকায় ১৯৩৫ সালেই আগস্টের প্রথম রবিবার আন্তর্জাতিক বন্ধু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। তবে একেক দেশ একেক দিনেও এ বন্ধু দিবস পালন করে। অন্যদিকে ১৯১৯ সালে হলমার্ক কার্ডের প্রতিষ্ঠাতা জয়েশ হল ফ্রেন্ডশিপ ডে উদযাপনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন এমনটাই জানা যায়। তখন আগস্টের প্রথম রবিবার সবাই বন্ধুদের কার্ড এবং উপহার পাঠিয়ে এই দিবসটি উদযাপন করত। ১৯২০ সালে এই দিনটি গ্রিটিং কার্ড ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন দ্বারা প্রচারিত হয়েছিল। সেখানে অনেক গ্রাহকই মনে করেছিল যে, শুভেচ্ছা কার্ডগুলো প্রচার করার জন্যই এ দিবসটি আনা হয়েছে। তবে এশিয়ান দেশগুলো এটির প্রতি বেশ আবেগপ্রবণ। এখানে প্রায় প্রতি মানুষের জীবনেই এমন একজন বন্ধু থাকে যাকে বিনা সংকোচে সবকিছু বলা যায়। যার ওপর বিশ্বাস রাখা যায়। ছেলেবেলা কিংবা মেয়েবেলা। যাই-ই বলি না কেন, স্কুল শুরুর দিনগুলোতে আমাদের অনেকেরই নতুন অভিজ্ঞতার নাম এই বন্ধুত্ব। পরিবারের গ-ি ছাড়িয়ে চেনা জগৎ যে এক লাফে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল সে তো বন্ধুরই হাত ধরে। আর আমাদের দেশে তো বন্ধুত্বের সম্পর্কটা একটু বেশিই মধুর। বহু গান লেখা হয়েছে বন্ধুত্ব নিয়ে। অনেকেই বন্ধুত্বকে জীবনের সেরা সম্পর্ক বলে মনে করেন। যে সম্পর্কের মধ্যে কোনো স্বার্থ থাকে না। সদ্য স্কুলজীবন পার করে কলেজপড়ুয়া আনিকা তাহমিদ মনে করেন, বন্ধু জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশের বেশ অনেকটা জুড়ে আছে। স্কুলজীবনে পড়াশোনায় সাহায্য, গেট টুগেদার, একসঙ্গে মজা করা, দুঃখ পেলে একে অন্যকে জানানো আর দুষ্টুমি ভরা দিনগুলোই জীবনের রসদ জোগায় বেঁচে থাকার। তবে আগে যেমন বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ মাধ্যম ছিল কম তাই হারিয়ে যেত অনেক সময়। তবে এখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দেশ ছেড়ে গেলেও কেউ হারাই না, এটি খুব ভালো একটা দিক বলে মনে করেন আনিকা। বন্ধুত্বের কোনো বয়স হয় না, হয় না লিঙ্গ। ছেলে-মেয়ে বন্ধুত্বে কোনো ফারাক থাকে না। বন্ধুর কাঁধে হাত রেখেই দুনিয়া দেখতে হবে। ইংরেজ লেখিকা ভার্জিনিয়া উলফ বলেছিলেন, কেউ কেউ পুরোহিতের কাছে যায়, কেউ কবিতার কাছে যায়, আমি যাই বন্ধুর কাছে। আবার গ্রিক দার্শনিক ও বিজ্ঞানী আ্যারিস্টটল যেমন বলেছেন, বন্ধু হতে চাওয়া একটা ক্ষণিকের কাজ, কিন্তু এমন ফল যা খুবই ধীরে পাকে। তিনি আরও বলেন, বন্ধুত্ব আবশ্যিকভাবেই অংশীদারত্ব। সমবয়সী বন্ধুত্বে এক ধরনের মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়। আবার বয়সে ছোট বড়তেও সুন্দর একটা বন্ধুত্ব তৈরি হতে পারে যদি মনের মিল থাকে। ত্রিশ ছোঁয়া শ্রাবণীর সঙ্গে বেশ গভীর বন্ধন চল্লিশ পেরোনো রাবার। দুইজনার সন্তান একই স্কুলে পড়ায় সেখান থেকেই এ বন্ধন শুরু হয়েছে। এটাও এক ধরনের গভীর বন্ধুত্ব বলে মনে করেন রাবা। কারণ এই আপনজন ছাড়া যান্ত্রিক শহরে একজন আরেকজনকে সব সময় পাশে পেয়েছেন, খোঁজ রেখে চলেছেন। বয়সের ফারাক কখনও মাথায় না রেখেই মিশেছেন আপন ভালোবাসায় নিঃস্বার্থভাবে। দুজনার মধ্য থেকে এখন এটি চলে এসেছে পরিবারের মধ্যেও।

বন্ধুত্বের সম্পর্ক এক মানুষকে আরেকজনের সঙ্গে মনের বন্ধনে আবদ্ধ করে। সমমনা লোকরাই সফলভাবে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারেন। তাই এবারের বন্ধু দিবসে বাসায় এ মানুষগুলোকে আমন্ত্রণ জানান, ফ্ল্যাক্সভর্তি কফি নিয়ে শুধু গল্প-আড্ডায় কাটিয়ে দিতে পারেন সুন্দর দিনটি। যেতে পারেন কোনো পার্কে, নদীর ধারে কিংবা সিনেমা দেখতে। কোনোটাই যদি হয়ে না ওঠে তবে বন্ধুকে অন্তত একটা খুদে বার্তা দিতে যেন ভুল না হয়। আর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠা যেমন সহজ কথা নয়, তেমনি ধরে রাখাও সহজ কথা নয়। এজন্যই মনে হয় বলে, বন্ধুত্ব হচ্ছে সুস্বাস্থ্যের মতো। হারালেই কেবল এর মূল্য অনুধাবন করা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *