জনতার কণ্ঠ ডেস্ক: কম কিংবা বেশি নয়, ভাত খেতে হবে মানুষের দেহের চাহিদা অনুযায়ী পরিমাণ মতো বলে পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও পুষ্টিবিদ।
সম্প্রতি বাংলাদেশের কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বিশ্বের যেসব দেশের মানুষ ভাত খায় সেই তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ দ্বিগুণ ভাত খায়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনপ্রতি গড়ে প্রায় ২০০ গ্রাম চাল খায়। কিন্তু বাংলাদেশে জনপ্রতি গড়ে চাল খাওয়ার পরিমাণ প্রায় ৪০০ গ্রাম। ভাতের পরিবর্তে অন্যান্য পুষ্টিকর অন্যান্য খাবার বেশি করে খাওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
কৃষিমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে দেশে মানুষের মধ্যে নানা আলোচনা এবং সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলানিউজের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং পুষ্টিবিদদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে চাওয়া হয় বাংলাদেশের মানুষ কেন ভাত বেশি খায়, ভাত কম বা বেশি খেলে কি ক্ষতি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো একটি দেশের খাবার নির্ভর করে, সেই দেশের জলবায়ু, সেই দেশের জীবনধারা, উৎপাদিত ফসল এবং সেই দেশের ঐতিহ্যের ওপর।
আবহাওয়াগত কারণে বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় ধান চাষ করা হয়, অন্যান্য খাদ্য শস্যের তুলনায় চাল সহজলভ্য এবং একবার রান্না করলে অধিক বার খাওয়া যায় বলেই এদেশের মানুষ বেশি ভাত খায়। একই সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার কারণেও মানুষ ভাত খেতে বেশি পছন্দ করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, প্রতিটা মানুষের দৈনন্দিন খাবার তালিকায় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অনুযায়ী সুষম খাবার থাকা প্রয়োজন। সেই সুষম খাবার হচ্ছে, খাদ্যের প্রধান একটা অংশ থাকবে কার্বোহাইড্রেট বা শ্বেতসার জাতীয় খাদ্য, এর সঙ্গে থাকবে আমিষ বা প্রোটিন জাতীয় খাবার, স্নেহ বা ফ্যাট জাতীয় খাবার, পাশাপাশি ভিটামিন ও খনিজ উপাদান এবং পানি থাকবে। এ সবকিছু মিলেই হচ্ছে সুষম খাবার।
তিনি বলেন, মানুষের খাবারের ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ থাকবে কার্বোহাইড্রেট বা শ্বেতসার জাতীয় খাবার। ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ থাকবে প্রোটিন জাতীয় খাবার। ১০ থেকে ১৫ শতাংশ থাকবে স্নেহ বা ফ্যাট জাতীয় খাবার। একই সঙ্গে একজন সুস্থ মানুষ দিনে আড়াই থেকে তিন লিটার পানি পান করবে। পাশাপাশি ভিটামিন এবং খনিজ উপাদান থাকে এমন খাবারগুলো সে তার খাদ্য তালিকায় যুক্ত করবে।
ডা. লেলিন বলেন, আমাদের দেশে কার্বোহাইড্রেট বা শ্বেতসার জাতীয় প্রধান খাবারগুলো হচ্ছে, ভাত, রুটি এবং ছাতু। আমাদের দেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ভাত হচ্ছে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবারের অন্যতম প্রধান উৎস। অতএব এটি কম বা বেশি খাওয়ার বিষয় নয়, একজন মানুষের খাবারের ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট থাকতে হবে। এর কম খেলে তার শরীরে পুষ্টিহীনতা দেখা দেবে এবং বেশি খেলে ভারসাম্যহীনতা হবে। অর্থাৎ ভাত বেশি বা কম নয় যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই খেতে হবে।
ভাতের বিকল্প হিসেবে কি খাওয়া যেতে পারে জানতে চাইলে ডা. লেলিন বলেন, আমাদের খাবারে ভাতের বিকল্প সন্ধান করতে চাইলে, সেটি হতে পারে গম, আলু, জব এবং ভুট্টার তৈরি খাবার। তবে বাংলাদেশে ভাতের বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো খাদ্য অভ্যাস আমাদের গড়ে ওঠেনি। আমাদের দেশে খালে-বিলে মাছ এবং সব জায়গায় ধান উৎপাদন হয় বলেই আমরা মাছে ভাতে বাঙালি। ফলে বাঙালির ভাত খাওয়া থেকে বিরত রেখে অন্য কোনো খাদ্যাভ্যাসে পরিণত করা স্বাভাবিক বিষয় হবে না।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ভাত খেতেই অভ্যস্ত। পাশাপাশি আমাদের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করতে হবে আমরা কেন ভাত খাই। গ্রামীণ এলাকায় রাতে ভাত রান্না করলে সেটা সকালেও পানি দিয়ে বা সামান্য তরকারি কিংবা লবণ, মরিচ পেঁয়াজ দিয়েও খাওয়া যায়। গ্রামীণ এলাকায় সকাল ও দুপুর এবং রাতেও তারা ভাত খায়। ভাতের এনার্জি ডেনসিটি বেশি থাকলেও নিউট্রিয়েন্ট ডেনসিটি প্রয়োজনের তুলনায় কম। তার পরেও রাতারাতি আমাদের ভাত খাওয়ার অভ্যাস পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। ভাতের পরিবর্তে অন্য কোনো খাদ্যশস্যের তৈরি খাবার খাওয়া দেশের বেশিরভাগ গ্রামীণ জনপদের জন্য কতটা সহজলভ্য, বাস্তবসম্মত এবং দামের বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের যে উদ্দেশ্য হেলথ ফর অল, সেখানে আমাদের কম পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ কিংবা অতিরিক্ত খাবার সবকিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং আমাদের স্বাস্থ্যসম্মত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত খাবারে এনার্জির পরিমাণ থাকবে ৫৬ থেকে ৬৫ শতাংশ যা খাদ্যশস্য থেকে আসবে। বাংলাদেশে দানাদার খাদ্যশস্যের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ধান। অন্যান্য দানাদার খাদ্য শস্য উৎপাদনের পরিমাণ কম। তারপরেও আমরা যদি শুধু ভাতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে অন্যান্য দানাদার শস্য খাবার চেষ্টা করি, সে ক্ষেত্রে আমাদের পুষ্টিকর খাবারের চাহিদার ব্যবধান অনেকটা কমতে পারে। সেই কারণেই ভাতের ওপর নির্ভরতা কমাতে বলা হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভাতের বিকল্প কোন দানাদার শস্য দিয়ে আমাদের খাদ্যের চাহিদা পূরণ হতে পারে জানতে চাইলে ড. নাজমা শাহীন বলেন, লাল আটা আমাদের নিউট্রিয়েন্ট রিকোয়ারমেন্ট পূরণ করতে পারে এবং লাল আটার দামও কম। ভারতে যেমন রুটি খায়, আমাদের এখানে তেমনটা সম্ভব নয়। এ কারণে আমরা দুই বেলা ভাত এবং এক বেলা রুটি খাওয়ার কথা বলছি।