মানসিক ভারসাম্যহীন নারীর নিরাপত্তা কোথায়?

জনতার কণ্ঠ ডেস্ক রিপোর্টার: নদী ও নারী—দুইয়ের মধ্যে এক অভিন্ন আর্তনাদ লুকিয়ে আছে। দুজনই আহত হয়, আক্রান্ত হয়, তবু সয়ে যায়। তবে প্রকৃতির দিকে তাকালে দেখা যায়, ভাঙনের মাধ্যমে, নীরব থাকার মাধ্যমে নদীও জবাব দেয়। নারীরা শিক্ষার আলোর মশাল হাতে বিচারকের আসন পর্যন্ত পৌঁছলেও এখনো তাঁদের প্রতিবন্ধকতা দূর হয়নি।

তবে তাঁরা সবটাই জয় করেছেন এবং করে চলেছেন।

এ সময়ের আলোচিত বিষয় সমাজের মানসিক ভারসাম্যহীন নারী। পারিবারিক উদাসীনতায় স্নেহ ও ঘরবঞ্চিত এসব নারীর আশ্রয় হয় ফুটপাত, টার্মিনালে। গাছতলায় কিংবা ওই সব জায়গায় আশ্রয় নেওয়ার কারণ ঝুটা-এঁটো খাবারের সহজলভ্যতা। স্পষ্ট করে বললে হরেক মানুষের যাতায়াতে কিংবা দয়ায় এসব স্থানে খাবার জুটে যায়, যা অন্য স্থানে দুষ্প্রাপ্য।

বেদনার বিষয় হলো, এসব নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় আশ্রয় নেওয়া মানসিক ভারসাম্যহীন নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন! কিন্তু যথাযথ বিচার তো দূরের কথা, এসব ধর্ষণের বিষয়ে থানায় ঠিকঠাক কোনো মামলাই হয় না। উল্টো ধর্ষণের শিকার হওয়া এসব অন্তঃসত্ত্বা নারীর সন্তানকে দত্তক নিতে বহু দম্পতির দৌড়ঝাঁপ চোখে পড়ে। আর এই নারীরা থেকে যান অন্ধকারে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের ভাষায়, এসব নারীর ধর্ষণের বিষয়ে কেউ অভিযোগ করে না, তাই মামলাও হয় না।

পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০১৯ থেকে ২০২১-এর এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ২৪ জন মানসিক ভারসাম্যহীন ভবঘুরে নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে মা হয়েছেন। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে দুটি। একটিতে আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। অন্যটি বিচারাধীন। এসব ঘটনায় জন্ম হওয়া ২৪ নবজাতকের আটজনকে আদালতের নির্দেশে দত্তক দেওয়া হয়েছে।

এই নারীরা জীবনসমুদ্রে সামান্য আশ্রয় নিয়ে টিকে থাকেন। সুযোগ নিয়েছে কিছু মানুষরূপী পশু। এ ধরনের প্রাসঙ্গিক উদাহরণ বান্দরবানে। ২০১৯-এর দিকে একজন নারী সেখানে আশ্রয় নেন এবং কিছুদিন বাদে ভারসাম্যহীন নারী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। একজন ব্যবসায়ী তাঁর দোকানে থাকা সিসিটিভির ফুটেজ দেখে ধর্ষণকারীকে শনাক্ত করেন। খোঁজ নিলে দেখা যাবে দেশের প্রায় সব কটি বিভাগেই এমন বর্বরতার ঘটনা ঘটে চলেছে।

এ দেশে সন্তান দত্তক নেওয়ার তেমন কোনো নিয়ম-রীতি নেই। তবে অভিভাবকত্বের এক ধরনের সুযোগ দেখা যায়। এ জন্য কেউ আদালতের শরণাপন্ন হলে পারিবারিক অবস্থা ও অর্থনৈতিক সচ্ছলতার বিষয়সহ কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। ভারসাম্যহীন এই নারীদের কাছ থেকে সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে তেমন সচেতনতামূলক কার্যক্রম নেই। তা ছাড়া আগত শিশুর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও সুস্থতা বিবেচনায় আশ্রয় পাওয়া স্থানের মানুষজনরাও বিষয়টিকে উৎসাহিত করে।

বিষয়টিকে গভীর পর্যবেক্ষণে দেখা যাবে, নারীকে সমাজ কিংবা সময় আবারও শুধু ভেদনযোগ্য জমিন হিসেবে সামনে আনছে। যেখানে উর্বরতায় ফেলে যাওয়া বীজে সন্তান উৎপাদনের ক্ষেত্রপট হিসেবে জাহির করা হচ্ছে। যেখানে সন্তান পেটে আসা এবং সন্তান প্রসব করিয়ে কাউকে গছিয়ে দিতে পারলেই যেন দায়িত্ব শেষ!

কিন্তু কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করছে না কেন এ ধরনের ভারসাম্যহীন নারীকে ধর্ষণের শিকার হয়ে পেটে সন্তান ধারণ করতে হলো। সরকারি-বেসরকারি কিছু মুখস্থ সংবাদ-সংলাপ ছাড়া তাঁদের আগলে রাখার তেমন কোনো নজির নেই। কখনো কখনো আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে এমন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে বলে শোনা যায়। সব মিলিয়ে সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাঁদের অবস্থা নজিরবিহীন ও নিম্নগামী।

এ ধরনের অবস্থায় সবার সচেতনতা জরুরি। তবে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো পারিবারিক আলিঙ্গন। বিস্তৃত অর্থে, যেহেতু এই নারীরাও কোনো না কোনো ঘরে, কারো না কারো গর্ভে জন্মেছেন, সেহেতু সেই সব মানুষের পারিবারিক আবহে তাঁদের গ্রহণ জরুরি। তাহলেই মিলবে সমাধান, মিলবে মুক্তি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *